ভালোবাসলেই কি ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিতে হবে ।

ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি যা মানুষের জীবনকে রঙিন করে তোলে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, ভালোবাসার সম্পর্কের ভেতরে গিয়ে মানুষ নিজের সত্তা, নিজের চিন্তা-ভাবনা, নিজের স্বাধীনতাকে হারিয়ে ফেলে। তখন প্রশ্ন আসে—ভালোবাসলেই কি ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিতে হয়? এর উত্তর একটাই—না, কখনোই নয়। ভালোবাসা মানে আত্মসমর্পণ নয়, বরং দুইজন আলাদা মানুষ একে অপরকে বোঝা, সম্মান করা এবং একসাথে বেড়ে ওঠা।

ভালোবাসা তখনই টিকে থাকে যখন সেখানে সমতা থাকে। সম্পর্ক মানে একপাক্ষিক দান নয়, বরং সমানভাবে দেওয়া এবং নেওয়া। যদি একজন মানুষ নিজের সব কিছু ছেড়ে শুধু অন্যজনের মতামত অনুযায়ী চলে, তাহলে সেই ভালোবাসা ধীরে ধীরে এক ধরনের চাপ হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে স্বাধীন চিন্তা নেই, নিজের জায়গা নেই, সেখানে ভালোবাসার সৌন্দর্যও হারিয়ে যায়।

একজন মানুষ যেমন নিজের পরিচয়ে অনন্য, তেমনি তার ব্যক্তিত্বও তার মূল শক্তি। সেই ব্যক্তিত্ব হারিয়ে গেলে ভালোবাসার মানেও হারিয়ে যায়। কারণ ভালোবাসা শুরুই হয়েছিল সেই ব্যক্তিত্ব, সেই স্বতন্ত্র ভাবনা, সেই আলাদা ‘আমি’-কে কেন্দ্র করে। যদি ভালোবাসার নাম করে সেই ‘আমি’-কে মুছে ফেলা হয়, তাহলে সম্পর্ক কেবল একতরফা হয়ে যায়, সেখানে অনুভূতি নয়, বাধ্যবাধকতা কাজ করে।

তবে এটাও সত্য, সম্পর্ক মানে কেবল নিজের মতো করে চলা নয়। সম্পর্ক মানে কিছুটা সমঝোতা, কিছুটা ছাড় দেওয়া। কিন্তু সেই ছাড় যেন নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলার পর্যায়ে না পৌঁছে যায়। নিজের সিদ্ধান্ত, নিজের স্বপ্ন, নিজের পছন্দকে পুরোপুরি বিসর্জন দেওয়া মানে নিজেকে অবহেলা করা। আর যে মানুষ নিজের প্রতি সম্মান হারায়, সে অন্য কাউকেও ভালোভাবে ভালোবাসতে পারে না।

ভালোবাসার আসল শক্তি হলো পরস্পরকে বোঝা এবং একে অপরের জায়গাকে সম্মান করা। দুজন মানুষই যদি একে অপরকে নিজের মতো থাকতে দেয়, তাহলে সম্পর্কটা অনেক বেশি গভীর হয়। প্রেম মানে কারো উপর কর্তৃত্ব নয়, বরং একে অপরের পাশে থাকা। সম্পর্কের সৌন্দর্য তখনই থাকে, যখন দুজনেই নিজের নিজস্বতা বজায় রেখে একে অপরের জীবনের অংশ হয়।

যখন কেউ ভালোবাসার নামে অন্যজনের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তখন সেই সম্পর্ক দমবন্ধ করে ফেলে। ভালোবাসা মানুষকে ছোট করে না, বরং বড় হতে শেখায়। যে ভালোবাসা তোমাকে তোমার স্বপ্ন, আত্মসম্মান, এবং ব্যক্তিত্ব থেকে দূরে নিয়ে যায়, সেটি কখনো সত্যিকারের ভালোবাসা হতে পারে না। সত্যিকারের ভালোবাসা তোমাকে এমনভাবে আগলে রাখে যাতে তুমি নিজেকে হারিয়ে না ফেলে, বরং নিজের ভেতরের আলোকে আরও উজ্জ্বল করে তুলতে পারো।

ভালোবাসা এমন এক বন্ধন যেখানে স্বাধীনতার মধ্যে থেকেও একে অপরের প্রতি দায়িত্ব থাকে। তুমি তোমার মতো করে বাঁচবে, তোমার পছন্দ-অপছন্দ, তোমার কাজ, তোমার লক্ষ্য—সব কিছু ধরে রাখবে, কিন্তু তবুও অন্যজনের প্রতি যত্নশীল থাকবে। এটাই পরিপক্ব ভালোবাসা। যে সম্পর্ক মানুষকে নিজের জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়, সেটা আসলে ভালোবাসার নয়, বরং নির্ভরতার আরেক রূপ।

ভালোবাসা কখনো দাবির ভাষায় কথা বলে না। ভালোবাসা শেখায় কীভাবে কাউকে নিজের জীবনে জায়গা দিতে হয় কিন্তু তাকে নিজের মধ্যে গিলে না ফেলা হয়। যেখানে মানুষ নিজেকে হারিয়ে না ফেলে, সেখানে সম্পর্ক অনেক বেশি দৃঢ় হয়। একজন মানুষ নিজের মতো করে স্বাধীন থাকলে, তবেই সে অন্যকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে পারে।

ভালোবাসা মানে কারো পেছনে নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলা নয়, বরং নিজের পরিচয় আরও পরিষ্কারভাবে জানা। যখন দুইজন মানুষ ভালোবাসার ভেতরে থেকেও নিজের ব্যক্তিত্ব, নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারে, তখনই সেই সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি পরিণত হয়।

তাই ভালোবাসলে নিজের প্রতি ভালোবাসাও বজায় রাখো। নিজেকে শ্রদ্ধা করো, নিজের মূল্য বোঝো। কারণ যে নিজেকে ভালোবাসতে জানে, সে-ই অন্যকে ভালোবাসতে পারে। সম্পর্ক যত গভীরই হোক, নিজের স্বপ্ন, নিজের চিন্তা, নিজের জীবনকে কখনো বিসর্জন দিও না। ভালোবাসা মানে আত্মবিসর্জন নয়, বরং দুজন মানুষের একসাথে বিকাশের যাত্রা।

ভালোবাসা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তুমি নিজে থেকেও ভালোবাসতে পারো, কিন্তু নিজের অস্তিত্ব হারাও না। যেখানেই তুমি নিজেকে হারাতে শুরু করো, সেখানেই ভালোবাসার সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। মনে রেখো, ভালোবাসা মানুষকে বদলায়, কিন্তু মুছে দেয় না। ভালোবাসা শেখায়, কিন্তু দমিয়ে রাখে না। ভালোবাসা বেড়ে ওঠার, হারিয়ে যাওয়ার নয়।

সকলকে ধন্যবাদ অনুচ্ছেদ টি পড়ার জন্য।

|| Join the Discord Server for more Details ||

VOTE @bangla.witness as witness

OR

SET @rme as your proxy