সবাই স্বার্থপর—তবে কেউ প্রকাশ করে, কেউ লুকিয়ে রাখে
আজ -২৩ য় আষাঢ় | ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | বর্ষাকাল |
আসসালামু-আলাইকুম। আদাব - নমস্কার। মাতৃভাষা বাংলা ব্লগিং এর একমাত্র কমিউনিটি আমার বাংলা ব্লগ এর ভারতীয় এবং বাংলাদেশী সদস্যগণ, আশা করি সবাই ভাল আছেন।
এটা বলাটা সহজ যে, “সবাই স্বার্থপর।” কিন্তু যখন কাছের মানুষটা মুখ ঘুরিয়ে নেয়, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে হারিয়ে যায়, তখন এই কথাটার বাস্তবতা বুকের মধ্যে পাথরের মতো ভারি লাগে। আমরা সবাই চাই, কেউ একজন নিঃস্বার্থভাবে আমাদের পাশে থাকবে। যে শুধুই “আমার” জন্য থাকবে, কোনো শর্ত ছাড়াই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝি, সেই মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। অনেকেই আসে, কিন্তু নিজের প্রয়োজন নিয়ে আসে। প্রয়োজন ফুরালেই সেই সম্পর্ক, সেই হাসি, সেই যত্ন—সব হারিয়ে যায় কুয়াশার মতো।
এটা সত্যি যে মানুষ জন্মগতভাবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে চায়। তাই নিজেকে আগে দেখে, নিজের সুখ, নিজের স্বার্থ আগে বোঝে। কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন সে অন্যের অনুভূতি, ভালোবাসা, সময়—সবকিছুকে নিজের প্রয়োজনের অংশ ভেবে নেয়। যতদিন আপনি তার উপকারে আসছেন, ততদিন আপনি “ভালো”। যেদিন আপনার আর কিছু দেওয়ার নেই, সেদিন আপনি হয়ে যান “অপ্রয়োজনীয়”।
এই সমাজ, এই চারপাশটাই এমন। অনেক মানুষ মুখে বলে “আমি পাশে আছি,” কিন্তু মনের ভিতরে থাকে হিসাব। কে কবে কী দিয়েছে, কবে কী নেয়া যাবে—সব কিছুর হিসাব চলে অনুভবের চেয়েও দ্রুত গতিতে। বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সম্পর্ক—সব জায়গাতেই এখন এক ধরনের বিনিময়মূল্য আছে। কেউ কষ্টের সময়টায় পাশে থাকে না, আবার ভালো সময়টায় এসে বলে, “তুই তো ভাগ্যবান!”
আমরা অনেক সময় নির্ভর করে ফেলি ভুল মানুষের ওপর। ভাবি, সে ঠিকই বুঝবে, ঠিকই একদিন অনুভব করবে। কিন্তু সে তো ব্যস্ত নিজের পৃথিবী নিয়ে। সেখানে আমাদের অনুভবের কোনো দাম নেই। এমনও হয়, যারা একসময় আমাদের চোখের জল মুছেছে, তারাই একদিন এমন কষ্ট দেয়—যেখানে আমরা নিজেরাই বুঝি না, কীভাবে ভুল করেছিলাম।
তবে একটা বিষয় মানতে হবে—সবাই একেবারে খারাপ না, শুধু সবার একটা নিজস্ব চাওয়া থাকে। কেউ সেটা প্রকাশ করে, কেউ লুকিয়ে রাখে। কেউ সোজাসাপটা বলে, “আমি চাই,” কেউ মুখে কিছু না বলে আপনার ভালোবাসা, সময়, ধৈর্য সবটুকু নিয়ে নেয়। তারপর যখন আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন বলে—“তুমি তো বদলে গেছো।”
এই বাস্তবতাগুলো কষ্ট দেয়, ভেঙে দেয় ভিতরের সরলতাকে। মনে হয়, আমি কি সত্যিই এতটাই বোকার মতো ছিলাম? এত বিশ্বাস করলাম, এত কিছু দিলাম, বিনিময়ে কিছুই পেলাম না! কিন্তু এখানেই একটা বড় শিক্ষা লুকিয়ে থাকে—সবাইকে বিশ্বাস করতে নেই, সবাইকে ভালোবেসে ফেলতে নেই। নিজের মনের দরজা খুলে দেওয়ার আগে ভাবতে হয়, সে কি সত্যিই আপনার মতো ভাবছে?
তবে এই কষ্টগুলো আমাদের আরও শক্ত করে তোলে। আমাদের শেখায়—নিজেকেও ভালোবাসা দরকার। বারবার অন্যের ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে নিজেকে ফাঁকা করে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আপনি যেদিন নিজেকে ভালোবাসবেন, সেদিন বুঝবেন—সবাই স্বার্থপর, কিন্তু আপনি নিজেকে সম্মান দিলে, আর কেউ আপনাকে অবহেলা করতে পারবে না।
জীবনে এমন মানুষও আসবে, যারা নিঃস্বার্থ নয়, কিন্তু সত্যি। তারা হয়তো আপনার জন্য কিছু করবে না, কিন্তু মিথ্যা প্রতিশ্রুতিও দেবে না। তাদের মূল্য বোঝা দরকার। কারণ আজকের দিনে, সৎ স্বার্থপরতাও অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। অন্তত তারা মুখে ভালোবাসা দেখিয়ে পেছনে ছুরি মারে না।
সবার সব কিছু দিয়ে আপনি সবার আপন হতে পারবেন না। কখনো চেষ্টা করেও কারো প্রিয় হতে পারবেন না, যদি আপনি তার প্রয়োজনের তালিকায় না থাকেন। তাই নিজেকে আগলে রাখুন। কারো স্বার্থের খেলায় আপনার মনকে বিসর্জন দেবেন না।
শেষ কথা হলো, মানুষ স্বার্থপর—এটাই বাস্তবতা। তবে আপনি কেমন মানুষ হবেন, সেটা আপনার হাতে। আপনি চাইলে এই স্বার্থপরতার ভিড়েও একটা আলাদা আলো হয়ে উঠতে পারেন। আপনি চাইলে কাউকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসতে পারেন, কোনো বিনিময় ছাড়াই পাশে থাকতে পারেন। আর এটাই আপনাকে মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠ করে তোলে।