"নানার বাড়িতে নৌকা ভ্রমণের সেই স্বর্ণালী দিনগুলো"
এটা আমার মনের কথা।শৈশবে নানার বাড়ি যাওয়া মানেই ছিল এক অন্য জগৎ, আর সেখানে নৌকা ভ্রমণ! সে এক সোনাঝরা অতীত, যার স্মৃতি এখনো মনকে ভিজে দেয়।আমার শৈশবের সেরা স্মৃতিগুলো যদি এক জায়গায় জমা করা যেত, তবে তার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকত নানাবাড়ি আর সেই বাড়ির চারপাশের শান্ত, সবুজ প্রকৃতি। এখনকার ফ্ল্যাট আর ডিজিটাল খেলার ভিড়ে সেই দিনগুলো যেন এক স্বর্ণালী স্বপ্ন।
তখন গ্রীষ্মের ছুটি বা ঈদের পরে যখনই নানার বাড়ি যেতাম, মনে হতো যেন রাজত্বে এলাম। বাড়িটা ছিল একদম গ্রামের ভেতরে, বিশাল উঠোন, পেছনের পুকুর আর চারদিকে সবুজ ধানখেত। আর সেই নানার বাড়িতে গেলে সঙ্গে পেতাম এক বিশাল দল আমার মামা-মামি, আর তাদের ছেলে-মেয়ে, অর্থাৎ আমার মামাতো ভাই-বোন! এর সঙ্গে যোগ হতো পাশের গ্রামের খালাতো ভাই-বোনেরা। সব মিলিয়ে এক হই-হুল্লোড়ের মেলা।এর মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ছিল নৌকা ভ্রমণের অপেক্ষা। নানার একটা মাঝারি আকারের কাঠের নৌকা ছিল। বর্ষার সময়ে বা যখনই খাল-বিল জলে ভরে উঠত, তখনই চলত নৌকা ভ্রমণের বায়না। দলটার নেতা সাধারণত বড় মামা বা কোনো একজন খালাতো ভাই হতো।
মনে আছে, একদিন দুপুরে সবাই মিলে ঠিক করলাম নৌকা ভ্রমণে যাব। নানার বাড়ি থেকে একটু হেঁটে গেলেই খাল। নৌকাটা সেখানে বাঁধা থাকত। নৌকায় ওঠার আগে এক দফা ঝামেলা হতোই! কে কোথায় বসবে, কে বৈঠা ধরবে, এসব নিয়ে চলত ছোট্টখাটো ঝগড়া। শেষমেশ, বড়রা আমাদের বসার জায়গা ঠিক করে দিত, আর আমরা সবাই ঠাসাঠাসি করে বসে পড়তাম।নৌকা যখন আস্তে আস্তে জলের উপর দিয়ে চলতে শুরু করত, সেই দৃশ্য ভোলার নয়। মামা বা কোনো এক ভাই বৈঠা ধরত। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, জলের মৃদু ঢেউ আর চারপাশের নিস্তব্ধতা সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত শান্তি! আমরা তো নৌকা ভ্রমণে যেতাম মূলত মজা করার জন্য, তাই আমাদের মধ্যে চলত গান, হাসি আর গল্প। মামাতো বোনগুলো কখনো গলা ছেড়ে পল্লীগীতি ধরত, আর আমরা গলা মিলিয়ে তাদের সঙ্গে তাল দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতাম।
মাঝে মাঝে মামা ইচ্ছে করে নৌকাটাকে জলের দিকে কাত করে দিত, আর আমরা ভয়ে ‘উইইই’ বলে চেঁচিয়ে উঠতাম। এটাই ছিল আমাদের প্রধান খেলা। আবার কখনো কখনো নৌকাটাকে নিয়ে একদম শালুক-পদ্মের মাঝখানে নিয়ে যেতাম। তখন সবাই মিলে হাত বাড়িয়ে ফুল তোলার চেষ্টা করতাম, যদিও বেশিরভাগ সময়ই ব্যর্থ হতাম। নৌকার নিচে ছোট্ট মাছেরা লাফালাফি করত, আর আমাদের মন ভরে যেত সেই দৃশ্য দেখে।
সূর্য যখন ডুবত, সেই দৃশ্য নৌকা থেকে দেখতে পাওয়া ছিল আরও সুন্দর। আকাশটা যেন নানা রঙে সেজে উঠত লাল, কমলা, হলুদ। সন্ধ্যা নামলে চারপাশ কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠত। তখন একটু ভয়ও লাগত, কিন্তু সবার সঙ্গ পেয়ে সেই ভয় কোথায় যেন মিলিয়ে যেত।বাড়ি ফেরার পথে নৌকা থেকে ভেসে আসা সন্ধ্যা আরতির শব্দ বা দূরে কোথাও আজানের সুর আমাদের জানাত যে দিনের আলো ফুরিয়েছে। বাড়ি ফিরে আসত আমাদের ক্লান্ত কিন্তু তৃপ্ত শরীর। হাত-মুখ ধুয়ে উঠোনে মাদুর পেতে সবাই মিলে বসতাম রাতের খাবারের জন্য। সারাদিনের হৈ-হুল্লোড়ের গল্প চলত তখন।
সেই সময়ের নিরাপত্তা, আনন্দ আর একসঙ্গে থাকার অনুভূতি এখন অনেক খুঁজেও পাওয়া যায় না। এখনকার জীবনে সব আছে, কিন্তু সেই মাটির টান আর মামা-মামি-ভাই-বোনদের সঙ্গে নিয়ে নৌকা ভ্রমণের সেই স্বর্ণালী অতীত তা কেবলই স্মৃতি। এখনো যখন চোখ বন্ধ করি, সেই ঠান্ডা জলের স্পর্শ আর নৌকার দুলুনিটা যেন অনুভব করতে পারি। এ স্মৃতিগুলো মনের মণিকোঠায় সারাজীবন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
আজ এখানেই শেষ করছি। অন্য কোন একদিন ভিন্ন ধরনের কনটেন্ট নিয়ে আপনাদের মাঝে হাজির হব। ততক্ষন পর্যন্ত আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।
X-Promotion
🎉 Congratulations!
Your post has been upvoted by the SteemX Team! 🚀
SteemX is a modern, user-friendly and powerful platform built for the Steem community.
🔗 Visit us: www.steemx.org
✅ Support our work — Vote for our witness: bountyking5