প্রতিটি প্রথম ফোঁটা — পুরনো স্মৃতির এক টান দেওয়া হাত
বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা সবসময় যেন কিছু বলে। না, শুধুই মাটিতে পড়ে ছড়িয়ে পড়া সেই মিষ্টি গন্ধ নয় — এটা কিছু অনেক বেশি। যেন কোনও হারানো সময়ের জানালা হঠাৎ খুলে যায়, যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা পুরনো চেনা মুখ। প্রতিটি প্রথম ফোঁটার মধ্যে আমার জন্য থাকে কোনও না কোনও স্মৃতি — প্রায়শই সেইসব, যেগুলো আমি জীবনের ব্যস্ততায় কোথাও ফেলে এসেছি, কিন্তু তারা আমাকে কখনও ছাড়েনি।
মনে আছে, সেই শৈশবের সন্ধ্যা যখন প্রথমবার বৃষ্টি শুরু হয়েছিল — প্রথমবার মা আমাকে ছাতা ছাড়াই ভিজতে দিয়েছিলেন। কাদামাখা মাঠে আমরা শিশুরা নাচতাম, লাফাতাম, আকাশকে হাতের তালুতে ধরে ফেলার চেষ্টা করতাম। তখন বৃষ্টি শুধুই জল ছিল না — সেটা ছিল স্বাধীনতা, ছিল হাসির সুর, ছিল সেই নির্দোষ অনুভব যা আজও হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে আছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিও বদলেছে, আমিও। এখন আমি জানালার আড়াল থেকে দেখি, ফোঁটার সুরে কোনো কবিতা খুঁজি, কিন্তু বাইরে বেরোনোর সাহস হয় না। জীবন যেন এক অদৃশ্য ছাতা ধরিয়ে দেয় — যেখানে ভিজে যাওয়ার অনুমতি নেই। কিন্তু প্রতিটি প্রথম ফোঁটা... এখনও ঠিক আগের মতো। আমায় ঠিক সেই জায়গায় নিয়ে যায় — সেই উঠোনে, সেই ছাদের কোণে, সেই কাঁচা রাস্তার বাঁকে যেখানে আমি ছিলাম... শুধু আমি।
কখনও ভাবি, স্মৃতিগুলো কি সত্যিই পুরনো হয়ে যায়? নাকি আমরাই এত নতুন হয়ে যাই যে পুরনো মুহূর্তগুলোর ছায়াও অচেনা লাগে? প্রতিটি প্রথম ফোঁটা একটা চেষ্টা করে — আমাদের পুরনো চেহারার সঙ্গে দেখা করানোর, সেই চেহারার সঙ্গে যেটাকে আমরা সময়ের সাথে সাথে বদলে ফেলেছি।
কিছু স্মৃতি এতটাই স্পষ্ট, যেন গতকালের কথা। যেমন, ঠাম্মার কোলে বসে বৃষ্টি দেখা — সেইসব গল্প যেখানে পরিরাও ভিজত, আর রাক্ষসদেরও ছাতা থাকত না। অথবা প্রথম প্রেমের সেই সন্ধ্যা যখন আমরা এক ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর সে কিছু না বলেও সব বলে দিয়েছিল। তখন বৃষ্টি ছিল রোমাঞ্চ, এখন শুধু অসুবিধে — ট্র্যাফিক, ভেজা জুতো, স্লিপারি মেঝে আর থেমে যাওয়া ঘড়ির কাঁটা।
কিন্তু প্রতিবার প্রথম ফোঁটা পড়ে, হৃদয় যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। যেন সময় চোখ বুজে নেয় সাময়িকভাবে। আমি অনুভব করি ফোঁটাগুলো আমার মুখে নয়, আত্মায় পড়ছে। আর যেন এক অদৃশ্য হাত — আমার তালুটা ধরে রাখে। সেই হাত হয়তো কোনও বন্ধুর, যে আজ আর নেই; হয়তো কোনও অসম্পূর্ণ প্রেমের, হয়তো কারো, যাকে শুধু স্মৃতিতে রেখে দিয়েছি।
প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা কোনো ঋতু আনে না — সেটা খোলে আমাদের ভিতরের দরজা, যেখানে আমাদের সত্যিকারের গল্প লেখা থাকে। এমন এক গল্প, যা শব্দে নয়, অনুভবে গাঁথা।
এই কারণেই আমি এখনও অপেক্ষা করি — প্রতিটি প্রথম ফোঁটার। যাতে আমি নিজের সঙ্গে আবার দেখা করতে পারি। যেন এই জোরে চলা দুনিয়ার কোলাহলে, আমি নিজের ভিতরের নীরবতাকে শুনতে পারি। যেন আবার অনুভব করতে পারি সেই হাতটাকে, যে কোনোদিন আমার সাথ ছাড়েনি — শুধু আমি-ই অনেকটা এগিয়ে গেছিলাম।
প্রতিটি প্রথম ফোঁটা আমায় শেখায় — ভুলে যাওয়া সহজ, কিন্তু অনুভব করা দরকার। আর সেই সব অনুভব, যেগুলো কোনও স্মৃতির সঙ্গে বাঁধা, তারা আমাদের আবার মানুষ করে তোলে — একটু কোমল, একটু সত্য।
হয়তো এই যে, জীবনের এই গতির মধ্যে যদি আমরা প্রতিটি প্রথম ফোঁটাকে চিনে নিতে পারি, তাহলে আমরা কোনোদিন হারিয়ে যাব না। কারণ, প্রতিটি প্রথম ফোঁটার মধ্যে এক পুরনো স্মৃতি আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় — এবং কখনও কখনও, শুধু সেই হাতটা ধরে ফেলা-ই যথেষ্ট হয়।