বর্ষাকালের সোনালি স্মৃতি "কলার ভেলায় বিল ভ্রমণ"

in আমার বাংলা ব্লগlast month

আসসালামু-আলাইকুম/আদাব।

হ্যালো বন্ধুরা, আপনারা সবাই কেমন আছেন? আশা করি আপনারা সবাই অনেক ভালো আছেন।হ্যাঁ, আমিও অনেক ভালো আছি।

শৈশব মানেই এক রঙিন অধ্যায়। দৌড়ঝাঁপ, বৃষ্টিতে ভিজে কাদা মাখামাখি, আর বন্ধুদের সাথে চিরন্তন হাসি-আড্ডার দিন। গ্রামের সেই মাটির গন্ধ, বর্ষার প্রথম বৃষ্টির সোঁদা মাটি, আর খাল-বিলের নোনতা হাওয়ায় এক অন্যরকম ভালো লাগা। আজও যখন আষাঢ়-শ্রাবণের মেঘ জমে, মনে পড়ে যায় ছোটবেলার সেই দিনগুলো।

1000083841.jpg

AI-generated image

আমাদের গ্রামটা ছিল প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এক নিস্তব্ধ জনপদ। বছরের বেশিরভাগ সময়ই শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশ। কিন্তু বর্ষা এলেই যেন একেবারে বদলে যেত। চারপাশের খাল-বিলগুলো পানি ভরে উঠতো। নতুন পানি এসে পুকুর-ডোবা থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তো বিলের দিকে। সেই পানির মধ্যে নানা রকমের মাছও ভেসে আসতো। আমরা বন্ধুদের দল ওত পেতে থাকতাম কখন বৃষ্টি নামবে, আর কখন নতুন পানি আসবে।বর্ষা এলেই আমাদের সবচেয়ে বড় আনন্দের আয়োজন হতো কলা গাছের ভেলা বানানো। গ্রামের আশপাশে কলা গাছ প্রচুর। কলা কেটে ফেলা হতো। ৩-৪টা মোটা মোটা কলা গাছের গোড়া জড়ো করে একটা ভেলা বানাতাম। দুই পাশে বাঁশের টুকরো দিয়ে বেঁধে শক্ত করা হতো। মাঝে মাঝে কিছু শুকনো গাছের ডাল বা নারকেল গাছের শুকনো পাতাও লাগানো হতো ভারসাম্যের জন্য।

ভেলা বানানো শেষ হলেই শুরু হতো আমাদের জল-ভ্রমণ। সকালের দিকে পানি একটু ঠান্ডা থাকতো। ভেলা নিয়ে বন্ধুদের সাথে চড়ে বসতাম। কে ভেলায় উঠবে, কে ঠেলে দেবে, কে থাকবে সামনে, সেই নিয়ে রীতিমতো ঝগড়া লেগে যেত। সবারই ইচ্ছে থাকতো ভেলার মাথায় বসার। কারণ সেখানে বসলে চারপাশের বিলের সৌন্দর্য আর ভেলা ভেঙে যাওয়ার ভয় কম। অনেকে আবার সাঁতার জানত না, তাদের আলাদা ভেলায় বসানো হতো। কখনও বা সাহস করে বড়দের ভেলায় ওঠার চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝে তো ২-৩টা ভেলা একত্র করে বড় ভেলা বানাতাম। সেই ভেলা একপাশে হেলে পড়ে গেলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পানিতে পড়তাম। তখন একসাথে জলে ডুব দিয়ে উঠতাম। চারদিকে কেবল হইচই আর হাসাহাসি।বর্ষাকালের পানিতে এক আলাদা মাদকতা থাকে। কাদা মাখা বিলের পানি, নরম ঠান্ডা স্পর্শ, আর বাতাসের দোলা… এই সব মিলিয়ে এক অনন্য অনুভূতি। আমরা ভেলা নিয়ে কখনও মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতাম। কেউ কেউ কলাপাতার ডিঙ্গি বানিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরত। তখনকার দিনে মাছ ধরাই ছিল বড় আনন্দের বিষয়। কখনও কেউ বড় শিং বা মাগুর ধরতে পারলে, সেই নিয়ে সারা বিকেল গল্প হতো।

মাঝেমধ্যে বিলের মাঝে থাকা গাছের ডালে বসে বিশ্রাম নিতাম। দূরে গ্রামের নারকেল গাছের মাথা, আর ধানক্ষেতের সবুজের ভীড়ে হারিয়ে যেতাম। বর্ষার আকাশ কখনও পরিষ্কার, কখনও মেঘে ঢাকা। হঠাৎ বৃষ্টি নেমে গেলে তখন সবাই ভেলায় বসেই বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দ করতাম। কেউ আবার ভেলার নিচে লুকানোর চেষ্টা করতো, যদিও পানির মধ্যে লুকানোর উপায় ছিল না।সন্ধ্যার দিকে যখন বাড়ি ফেরার সময় হতো, শরীরে কাদা, ভেজা কাপড়, ঠান্ডায় কাঁপা শরীর নিয়েও মুখে থাকত একরাশ হাসি। বাড়ি ফিরলে মা বা দাদি বকাঝকা করতো। ‘এইতো, আবার বিলের পানিতে নামছিস! ঠান্ডা লাগবে! জ্বর হবে!’ তারপরও আমরা শুনতাম না। কারণ জানতাম, পরের দিন আবার নতুন পানিতে নতুন ভেলা নিয়ে নামব।এভাবে কয়েকটা দিন চলে যেত বর্ষার প্রথম ভাগে। কখনও কখনও নতুন পানি আসলে, ভেলায় ভেসে একেবারে অন্য গ্রাম পর্যন্ত চলে যেতাম। সেখানে অপরিচিত কেউ দেখলে ডেকে বলত, ‘এই কারা রে তোরা?’ আমরা নাম বলে হাসতাম। কতবার যে নতুন গ্রাম ঘুরেছি, নতুন বন্ধু বানিয়েছি তার শেষ নেই।

আজ এই শহুরে জীবনে আটকে থাকা ভিড়ভাড়া আর কংক্রিটের আবাসে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে সেই শৈশব। এখন আর খাল-বিলের পানিতে ভেলা বানানোর সুযোগ নেই। কলা গাছের ভেলা নয়, বরং স্মার্টফোনের স্ক্রিনে আটকে আছে নতুন প্রজন্ম। আমরা তখন প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠেছি। প্রকৃতি আমাদের খেলাঘর ছিল।বর্ষাকাল আসলেই মনটা হু হু করে ওঠে। জানালার পাশে বসে যখন বৃষ্টির শব্দ শুনি, মনে হয় আবার যদি সেই দিনে ফিরতে পারতাম! আবার যদি বন্ধুদের ডেকে কলা গাছ কেটে ভেলা বানাতাম। বিলের ঠান্ডা পানিতে ডুব দিতাম। ভেলার উপর বসে বৃষ্টির ভেজা বাতাস গায়ে মেখে দূরের মেঘমালা দেখতাম।

এখন শুধু স্মৃতি। স্মৃতি বলেই হয়তো এতটা মায়া লাগে। তবে এই স্মৃতিগুলোই তো বাঁচিয়ে রাখে সেই শৈশবকে। প্রতিবার বর্ষায় সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে হাসি পায়, আর বুকের ভেতর এক অদ্ভুত কষ্টও। জীবন যতই এগিয়ে যাক , যত প্রযুক্তিরই আবরণে ঢেকে যাক গ্রামের সেই বর্ষার দিন আর কলা গাছের ভেলার স্মৃতি হৃদয়ের অমলিন ঐশ্বর্য হয়ে রয়ে যাবে আজীবন।


আজ এখানেই শেষ করছি। অন্য কোন একদিন ভিন্ন ধরনের কনটেন্ট নিয়ে আপনাদের মাঝে হাজির হব। ততক্ষন পর্যন্ত আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।

standard_Discord_Zip.gif

আমার পরিচয়

1000024149.png

আমার নাম মোঃ ফয়সাল আহমেদ। আমি ঘোরাফেরা, লেখালেখি এবং ফটোগ্রাফি করতে ভালোবাসি। ভ্রমণের মাধ্যমে নতুন জায়গা ও সংস্কৃতি আবিষ্কার করতে আমার আনন্দ লাগে। বিভিন্ন মুহূর্ত ও দৃশ্যকে ক্যামেরার লেন্সে বন্দি করা আমার শখ। লেখালেখির মাধ্যমে আমি আমার ভাবনা, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিগুলো শেয়ার করতে ভালোবাসি। প্রকৃতির সৌন্দর্য, মানুষের জীবনধারা এবং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার লেখার মূল অনুপ্রেরণা। আমি প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করার চেষ্টা করি এবং সেগুলোকে স্মৃতিতে ধরে রাখি। এসব অভিজ্ঞতা আমাকে নতুন করে জীবনকে দেখার অনুপ্রেরণা দেয়।

1000024154.png

1000024151.gif

Posted using SteemX

Sort:  
 last month 

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

🎉 Congratulations!

Your post has been manually upvoted by the SteemX Team! 🚀

SteemX is a modern, user-friendly and powerful platform built for the Steem ecosystem.

🔗 Visit us: www.steemx.org

✅ Support our work — Vote for our witness: bountyking5

banner.jpg