"কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সেই শৈশব
![]() |
---|
শৈশব আমাদের জীবনের সবচেয়ে নির্মল, নিস্পাপ ও আনন্দময় একটা অধ্যায়। আমরা যারা এই মুহূর্তে বড়দের দলে দাঁড়িয়ে আছি, তাদের সবার মনেই একবার না একবার এই প্রশ্ন জাগে, “কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সেই শৈশব?” তখন ছিল না আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া, ছিল না মোবাইল কিংবা ইন্টারনেট। ছিল শুধুই প্রাণবন্ত দিন, মাটির গন্ধ, কাঁচা রোদ আর মুক্ত আকাশের নিচে হাসিখুশি জীবন। সারাক্ষণ খেলায় মেতে উঠা সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে আসা।
আমাদের জীবনে একটা সময় ছিল, যখন সকালে ঘুম ভেঙে যেতে চোখে রোদ পড়ার কারণে, ঘুম থেকে উঠেই পাখির ডাক কানে শুনতে পেতাম। মা মুখে তুলে দিত ভাত-ডাল বা মুড়ি-দই, আর হাত-মুখ মুছেই ছুটে চলে যেতাম মাঠে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে খেলতাম, নালায় কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসাতাম। বিকেল হলেই কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, লুকোচুরি, আর চোর-পুলিশ খেলার মেলা বসে যেত বাড়ির উঠোনে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা-মার ডাকে ঘরে ফেরা হত, তারপর গল্পের বই বা ঠাকুরমার ঝুলি অথবা দাদির কাছে বসে গল্প শোনা – এতটুকুই ছিল আমাদের সুন্দর পৃথিবী।
![]() |
---|
কিন্তু এখন? এখনকার শিশুদের শৈশব বন্দি শুধুমাত্র চার দেয়ালের মাঝেই। চোখে মোবাইল, হাতে ভিডিও গেম, আর মুখে কৃত্রিম ভাষার ছোঁয়া। এখনকার শিশুরা প্রকৃতির সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। তারা জানে না গাছ কিভাবে বেঁচে থাকে, জানে না পাখি নিজের বাসা কিভাবে বানায়, জানে না কীভাবে মাটিতে পড়ে যাওয়া বীজ থেকে চারা গজায়। আজকের দিনে খেলাধুলা মানে মোবাইল স্ক্রিনে কিছু ক্লিক করা। আরে ক্লিক করতে করতেই তাদের জীবনের শৈশব বা আনন্দঘন মুহূর্তটা তারা পার করে ফেলে। তারা বুঝতেই পারে না শৈশবের আসল মজা কোথায়।
আমাদের সময়টাতে ভুল ছিল না, ছিল না হিংসা কিংবা ঈর্ষা। কারো পুতুল থাকলে, সবাই মিলে পুতুলটা দিয়ে খেলার মেতে উঠতাম। কারো কাছে বই থাকলে সবাই পড়ে নিতাম। এখনকার শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় প্রতিযোগিতা, গর্ব আর একাকীত্ব। এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী কিন্তু আমরা নিজেরাই। আমরা আমাদের ব্যস্ত জীবনের ছুতোয় শিশুদের প্রকৃতির কাছ থেকে অনেক দূরে রেখেছি।
শৈশব হারিয়ে যাওয়ার এই ব্যথা কেবলমাত্র একটুখানি আফসোস নয়, এটি আমাদের জন্য গভীর শূন্যতা। আমরা হয়তো বড় হয়েছি, কিন্তু সেই শৈশবের আনন্দ, নিষ্পাপ হাসি, সহজ সম্পর্ক আর প্রকৃতির সান্নিধ্য—এসব কিছু হারিয়ে গেছে। আধুনিক জীবনের ভিড়ে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের ভেতরের শিশুকে। হয়তোবা কখনো যদি একটু সময় পাই নিরিবিলি সময় কাটানোর চেষ্টা করি। তখন কিন্তু মনের মধ্যে হঠাৎ করেই সেই শৈশবের স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে। বন্ধুদের সাথে গলায় গলা মিলিয়ে কথা বলা, সবার সঙ্গে বসে আনন্দ করা সেই মুহূর্তগুলো এখন শুধুমাত্র স্মৃতি।
![]() |
---|
তবু মাঝে মাঝে যখন পুরনো ছবিগুলো দেখতে শুরু করি, বা পুরনো খেলনার বাক্স খুলে বসি, তখন মনে হয় – সেই শৈশব এখনও আমাদের মাঝে কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে। শুধু দরকার একটু মন খোলা হাসি, একটু ফিরে তাকানোর ইচ্ছে, আর নিজের সন্তানের মধ্যেও সেই সহজ শৈশবের কিছুটা ফেরত আনার চেষ্টা। আমরা যদি সবাই মিলে একটু চেষ্টা করি, তবে এখনো সম্ভব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সেই পুরোনো শৈশবের স্বাদ দিতে পারি। প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া, মাটির গন্ধ, সরলতা আর ভালোবাসা এগুলোই পারে একটি শিশুকে মানুষের মত মানুষ করতে। শৈশব হারিয়ে গেছে তো কি হয়েছে, তবে সেটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা থেমে থাকা কখনোই উচিত নয়।
প্রতিটা মানুষ চেষ্টা করলেই কিন্তু তার সন্তানের মাধ্যমে তার হারিয়ে যাওয়ার শৈশব ফিরিয়ে আনতে পারে। তবে আমরা নিজেরা আধুনিকতার ছোঁয়ায় এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সন্তানকে সময়ে দেয়ার মত সেই সময় আমাদের হয়ে ওঠে না। কিভাবে আমরা আমাদের সেই পুরনো শৈশবের স্মৃতি তাদেরকে মনে করিয়ে দেব। কিভাবে আমরা সেই খেলার মাঠে তাদেরকে ফিরিয়ে নেব। আমাদের নিজেদের সময় হয়ে ওঠেনা। তবে আমরা যদি চেষ্টা করি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের 24 ঘন্টা থেকে অন্ততপক্ষে একটা ঘন্টা তাদের জন্য ব্যয় করাটা সম্ভব, শুধুমাত্র আমাদের একটু চেষ্টা থাকতে হবে।