চাচার বিদেশে চলে যাওয়ার মহূর্ত

in Incredible India3 days ago

সকালের আলোটা আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি ভারী লাগছে। চারপাশে সব কিছু যেন থমকে গেছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক চিলতে রোদের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ছে সে দুই মাসের স্মৃতিগুলো হাসি আনন্দ আড্ডা আর আমাদের সবার প্রিয় চাচা কে ঘিরে এক টুকরো জমজমাট জীবন। চাচা ছিলেন দীর্ঘ ৩ বছর বিদেশে তার জমজ দুই মেয়ে যাদের জন্মের সময় তিনি পাশে থাকতে পারেননি। মেয়ের কোলে আশ্রয় না পাওয়া সেই দুই নিষ্পাপ মুখের টান আর দেশের মাটির গন্ধে মন আনচান করে উঠছিল বলে ছুটি নিয়ে ফিরেছিলেন এই দুই মাসের জন্য।

IMG_20250805_202645.jpg

শুধু মেয়েদের নয় আমাদের সবার সঙ্গে একটু সময় কাটাতে আপন ভালোবাসার বাঁধন গুলোকে ছুঁয়ে যেতে। যেন পুরো পরিবার এক উৎসবের আমেজ এনেছিল। প্রথম দিন থেকেই আমরা সবাই হুল্লোড় খুশি আর ব্যস্ততায় মেতে উঠেছিলাম। কেউ অফিসে ছুটি নিয়েছে কেউ রান্নাঘরে ঘুরঘুর করছে আবার কেউ জামা কাপড়ের কেনাকাটা।

আমার জমজ দুই বোনেরা,তার বাবার গলায় ঝুলে থাকত সারাক্ষণ আর চাচা এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরাত না তাদের উপর থেকে। কিন্তু সময় টাকে আর ধরে রাখা যায়। দেখতে দেখতেই দুই মাস পেরিয়ে গেল। আবার সেই বিদায়ের খন এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। চাচাকে আজকে বিদায় দিতে হবে। বিদেশ যাওয়ার দিনটা কোন সাধারণ দিন নয় আমাদের কাছে। তাই আমরা ঠিক করলাম আজকের এই দিনটা তাকে ভালোবাসা দিয়ে মমতা দিয়ে স্মৃতিতে ভরিয়ে তুলব।

IMG_20250805_202747.jpg

আমার আম্মু চাচী আর আমি সকাল হতেই উঠে পড়লাম। সত্যি বলতে ঘুম ভালো হয়নি রাতে। চোখের কোণে কেমন জানি অদ্ভুত এক অনুভূতি। তারপরও মন শক্ত করলাম কারন আর চাচার জন্য অনেক কিছু তৈরি করতে হবে। রান্না ঘরে চুলাই তখন নারিকেল পিঠা চুষি পিঠা জামাই সোহাগী পিঠা মাংসের পিঠা নানা ধরনের আচার আর মিষ্টির ঘ্রাণ। আমরা ঠিক করেছিলাম এমন কিছু রান্না করবো যা চাচা নিজের হাতে ব্যাগে করে নিয়ে যেতে পারবেন বিদেশে গিয়ে সবাই মিলে দেশের খাবার মনে করে খাবেন।

IMG_20250805_202805.jpg

ওখানে চাচার অনেক সহপাঠী আছে তারাও অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশ থেকে কি কি নিয়ে যাবে চাচা খাওয়ার জন্য। প্রথমেই চাচি নারিকেল পিঠা তৈরি করলেন সেই সাথে মাংসের পিঠা আর আমরা এদিকে বিস্কিট পিঠা তৈরি করার জন্য লেগে পরলাম। আম্মু বানালেন আমের আচার, চালতার আচার, বড়াইয়ের আচার, আরো অনেক কয় ধরনের আচার। চাচি গরুর মাংস দিয়ে সুন্দর করে ভুনা করে দিলো শুখনো শুখনো করে।

IMG_20250805_202825.jpg

এক এক করে আরো অনেক কিছু তৈরি করে দিলাম আমরা সবাই মিলে। আসলে সবাই মিলে একটা কাজ করলে খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। এবং আমাদের হাতে সময় ছিল খুব অল্প।যাইহোক বাড়ির ছোটরাও বসে থাকেনি চাচার জমজ মেয়েরা ছোট ছোট হাতে খাবারের বাটি এনে দিচ্ছিল। আমার চোখে বারবার অল্প করে জল এসে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল এই দৃশ্যটা যদি সময়ে আটকে রাখতে পারতাম। এক সময় খাবারগুলো সুন্দরভাবে প্যাক করা হলো। একেকটা প্যাকেটে শুধু খাবার না ভালোবাসার মোরনে মোড়ানো আমাদের অনুভূতির প্রতিচ্ছবি।

IMG_20250805_202848.jpg

চাচা সুন্দর একটা শার্ট পড়ে বের হলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক এক করে সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। যখন আমার দিকে এলেন তখন মুখে হাসি কিন্তু চোখে লুকানো অশ্রু আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ভালো থেকো চাচা আবার এসো বললাম ফিসফিস করে। তোমাদের ছাড়া মন টিকবে না বললেন তিনি কাপা গলায়। গাড়ি এসে গেল চাচা মেয়েদের কোলে নিয়ে শেষবারের মতো চুমু খেলেন আমার দাদিকে জড়িয়ে ধরলেন চাচির চোখ মুছিয়ে বললেন সবাই ভালো থেকো।

গাড়ি চলতে শুরু করলো আমরা সবাই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নারছি,সাথে আমার দুই বোন কাঁদছে আর আমার মনে হচ্ছে এই একটি মুহূর্ত ভালবাসা আবেগ কষ্ট সব একসাথে বুকের মধ্যে জমাট বেধে গেছে। চাচা চলে গেলেন কিন্তু তার ফেলে যাওয়া স্মৃতিগুলো থেকে গেল রান্নাঘরের ঘ্রাণে বারান্দায় আড্ডায় আর ছোট্ট ছোট্ট চুমুর স্মৃতিতে। এই দুই মাস যেন আমাদের জীবনের এক সোনালী অধ্যায় ছিল। চাচার হাসি তার জমজ মেয়েদের খুনসুটি আর রান্নাঘরে ব্যস্ততা সবকিছুই ছিল নিখাদ ভালবাসা আর পারিবারিক বন্ধনে এক নিদর্শন।

এবার তিনি ফিরে গেলেন দেশের বাহিরের দায়িত্বের ডাকে। কিন্তু তার জন্য বানানো প্রতিটি পিঠা প্রতিটি আচারের জারে যে ভালোবাসা ভরে দিয়েছি তা যেন বিদেশ বিভুইয়েও তার হৃদয়ে উষ্ণ করে রাখে। আজ এ পর্যন্তই সবাই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন আল্লাহ হাফেজ।

Sort:  
Loading...

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

 2 days ago 

Thank you so much

 2 days ago 

আপনার হাতের চালতার আচারটা ভীষণ মনে পড়ছিলো আজকের এই পোস্টটা পড়তে গিয়ে খুব মিস করছি দিনগুলো,,।