একজন নীরব যোদ্ধার নাম-"বাবা"steemCreated with Sketch.

in #life2 days ago (edited)

Fathers.webp
আমার সুপার হিরো "বাবা"♥️

নিজের কথা তো জীবনে অনেক লিখেছি, অনেক বলেছি। আজ আমার সুপার হিরোকে নিয়ে কিছু কথা বলবো বা লিখবো।
ছবিতে যেই মানুষটাকে দেখতেছেন, উনি আমার "বাবা", আমার সুপার হিরো। আমি যখন ২০০৩ সালে ক্লাস থ্রিতে পড়াশোনা করতাম, তখন উনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে প্রথম সৌদি আরব যান। আর সেই থেকেই ওনার প্রবাস জীবন শুরু। অনেক কষ্ট করেছেন প্রবাসে।
আজ ২০২২ সাল, আজও উনি প্রবাসী নামের খাতা থেকে নামটি কাটতে পারেননি তার ছেলে সন্তান আর সংসারের একটু সুখের জন্য। আজও তিনি একজন প্রবাসী।

২০০৩-এর প্রথম দিকে বাবাকে চিঠি লিখতাম আমি। এরপর ২০০৩ সালের শেষের দিকে আমার বাবা আমার হাতে মোবাইল দিয়েছেন। যখন গ্রামে সর্বোচ্চ ১০টা মোবাইল ছিল, তখন থেকেই আমার হাতে মোবাইল। এরপর ২০০৮ সালে আমাকে Nokia-N73 মোবাইলটা কিনে দেন। আর তখন থেকেই নেট জগতে আমার প্রবেশ। আর তখন থেকেই ইন্টারনেট নিয়ে পরে থাকতাম। ভালো লাগতো আমার। নতুন নতুন অ্যাপস, ওয়েবসাইট, নতুন নতুন ফিচার সম্পর্কে জানার ক্ষুধা সবসময়ই ছিল এবং এখনও আছে।

২০১৩ সালে আমাকে ল্যাপটপ কিনে দেন। ২০১৪ সালে iPhone কিনে দেন। Northern University of Bangladesh থেকে BBA পড়তে দিয়েছেন। এই সব কিছুই বাবা প্রবাসে থেকেই করেছেন। অথচ, ২০০৩ থেকে ২০১২ পর্যন্ত টানা ৯ বছর উনি প্রবাসে ছিলেন। একবারের জন্যও দেশে আসতে পারেননি। আমাদের কাউকেই একটা পলক দেখতে পারেননি। আমার ছোট বোনটাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে পারেননি। আর আমি বাবার হাত ধরে কখনো বাজারে যেতে পারিনি। এই সব কিছুই গ্রাস করে নিয়েছে এই প্রবাস নামক শব্দটায়।

তবে কখনো আফসোস ছিল না। কারণ, আমি যখন যা, যেভাবে চেয়েছি সবটাই পেয়েছি, এমনকি আজও দিচ্ছেন। আসলে এই মানুষটার মুখে কখনো আমি "না" শব্দটা শুনিনি। আসলে এই মানুষটা কি কখনো না বলতে জানেন কিনা তাও জানি না। যতই কষ্ট হয়েছে, আমাকে দিয়েছেন, আমার বোনদের দিয়েছেন, বোনের ছেলে-মেয়েদের দিয়েছেন। অথচ নিজেকে ছেড়া গেঞ্জি পরেছেন।
বাবারা আসলেই অদ্ভুত। সত্যিই অনেক অদ্ভুত হয়।

এরপর ২০১৮ সালে আমাকে ৩ লাখ টাকা খরচ করে বাইক কিনে দিয়েছেন। অথচ আমি কখনোই তাকে কিছু দিতে পারিনি। আমার মনে আছে, ২০১৮ সালে যখন আমি চাকরি পেয়েছিলাম, তখন যেকোনো কারণে আমাকে একদিন এসে বলেছিলেন, "তোর কাছে ১০০ টাকা হবে?"
আমি কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেদিন মনে হয়েছিল আমার মানিব্যাগে যত টাকা আছে সবটা দিয়ে দিই। পৃথিবীর সকল টাকা এনে বাবার পায়ের কাছে রেখে বলি, "আপনার যতটা লাগে নিন।"
কিন্তু বলতে পারিনি। কারণ আমিও মধ্যবিত্ত বাবার মধ্যবিত্ত সন্তান। আমাদের কাছে ওতো টাকা থাকে না। কিন্তু বুক ভর্তি স্বপ্ন থাকে। তখন আমি ৫০০ টাকার নোট দিয়ে বললাম, "নেন।" বাবা বললেন, "১০০ টাকার নোট নেই? ১০০ টাকা লাগবে আমার।" আমি বললাম, "নেই, এটাই নেন।" বাবা বললেন, "তোর লাগবে না? তুই আমাকে দিলে বাকি মাস কিভাবে চলবি?"
আমি আর কি বলবো! আমি হেসে বলেছিলাম, "আমার লাগলে তো আপনি আছেনেই।"

এরপর আর কখনো কিছু দেওয়া হয়নি তাকে। তবে আজকে প্রথম ছবিতে দেখছেন বাবার হাতে একটা কাগজ বা চিঠি। এটা আসলে কাগজ না, এটা একজন ইউটিউবার বা অনলাইন প্লাটফর্মারের জন্য সোনার হরিণ। একজন ইউটিউবারের সব কিছুই বলতে পারেন, যা অনেকে কয়েক বছর সাধনা করেও পায় না বা পাননি। এটা গুগল এডসেন্স, যারা অনলাইনে পেমেন্ট নেন তারা এটা সম্পর্কে জানেন।
যাইহোক, আমি ইউটিউবে যখন মনিটাইজ পাই, তখন আমার সব কিছু আমার বাবার নামেই করি এবং ব্যাংক একাউন্টও তারটাই যোগ করি। আর এই সোনার হরিণটাও বাবার হাত দিয়েই তুলেছি।

আমার বাবা হয়তো এই চিঠির মূল্য বুঝেননি বা জানেন না। বাবা শুধু এতটুকু জিজ্ঞেস করেছিলেন, "এই চিঠি কোথা থেকে আসছে?"
আমি বললাম, "বাবা, আমেরিকা থেকে পাঠিয়েছে।" তখন হয়তো কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছেন। আর বললেন, "আমেরিকা থেকে পাঠাইছে?" অনেকটাই অবাক হয়েছিলেন।
আমি দেবার মধ্য এতোটুকুই দিয়েছি বাবাকে। তবে দেশে থাকতে মাকে অনেক শাড়ি কিনে দিয়েছি, অন্তত প্রতি ঈদে দিয়েছি। কিন্তু বাবাকে এখন পর্যন্ত ২টা গেঞ্জি দিয়েছিলাম। কারণ বাবাকে ওতোটা কাছে পাওয়া হয়ে ওঠেনি আমার। বাবাকে যখন গেঞ্জি দিতাম, তখন দেখতেন, "এতো টাকা দিয়ে গেঞ্জি কেনার কি দরকার ছিল? আমার জামা কাপড় ঘর ভরা।"
আমি বলতাম, "নেন।" অথচ মায়ের কাছে গিয়ে বলতেন, "গেঞ্জিটা কিন্তু সুন্দর।"
বাবারা না কেমন যেন! দেখবেন ঘর ভর্তি বাবাদের কোনো জামাকাপড় থাকে না। আর মার্কেটে গেলে যত সস্তার মধ্যে কেনা যায় সেটাই কিনে। তাদের ঘড়ি যতক্ষণ না নষ্ট হয় ততক্ষণ ফেলে দেন না। একেই ফ্রেমে বারবার গ্লাস চেঞ্জ করে চশমা পড়েন। আর ঘরের সবচেয়ে সস্তা মোবাইলটাই বাবার হাতে থাকে।

একটা জিনিস খেয়াল করবেন, বাড়িতে যখন কোন অনুষ্ঠান হবে, তখন সবচেয়ে কম দামী ড্রেসটা যে পরে থাকেন, উনিই, আর কেউ না, উনি হকেন বাবা।

আজ অনেকেই আমাকে টিকটকে, ফেসবুকে ফলো করেন। অনেকেই অনেক জায়গা থেকে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেকে ইউটিউব ভিডিও দেখে আমাকে চিনেন। এই সবটাই কিন্তু আমার বাবার হাত ধরে। আমার বাবা ছাড়া যেমন আমার জন্মের অস্তিত্ব থাকতো না, ঠিক তেমনি অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও আমার বাবা ছাড়া আমি অস্তিত্বহীন হতাম।
যাইহোক, এরপর অনেক বছর, অনেক দিন কেটে গেছে আমার জীবনে। অনেক কিছুই ঘটেছে আমার জীবনে। এই সব কিছুর মধ্যেও যে সবসময় ছায়ার মতো আমার পাশে ছিল, সে আর কেউ না, এই মানুষটাই।

এমনকি, ২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে আমি দুবাই আসি। আজ অব্দি কোনো কাজ পাইনি। ৪টা দেশ ঘুরেছি। এই সব কিছুর খরচটাও এই বোকা মানুষটাই দিয়েছে। জানেন, বাবারা প্রচুর বোকা হয়, নিজে এক টাকা না খেয়ে পারলে খাবেনা। তখন তার মতো কিপটা আর কেউ নেই। অথচ ছেলে-মেয়ের বেলায় সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দানশীল হয়ে যায়। আসলেই বোকা হয় বাবা গুলো।
আমি যে এই ৭-৮ মাস কোনো কাজ পাইনি, এতে একদিনও সে রাগ করেনি বা বলে নি "কিছু করো না কেন, করতে হবে" এমন কিছু। বাবা সবসময়ই বলে, "আমার যত কষ্ট হোক সমস্যা নাই, তুই তোর লক্ষ্যে পৌঁছা। তুই দুবাই থেকে না, ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে আসবি! তুই ঘুরতে থাক।"
অনেকেই বলেন আমি এতো সাহস, এতো এনার্জি কোথা থেকে পাই। এই বাবা নামক শব্দটাই আমার সাহস, এই বাবাই আমার এনার্জি।
আমি জানি না, আমি কখনো সফল হতে পারবো কিনা। তবে যদি কোনো দিন সফল হতে পারি, সেদিন আমার সফলতার পিছনে একটা নামেই লেখা থাকবে "বাবা" — আমার সুপার হিরো।🥀

সেদিন আমার সফলতার ক্রেডিট কেউ নিতে পারবে না। আমার বড়লোক আত্মীয়-স্বজন, কাছে মানুষ, পাশের মানুষ কেউ না।
প্রথম পাবেন আমার বাবা, আর দ্বিতীয় হলো আমার মা, যিনি প্রতি মোনাজাতে জায়নামাজে বসে আমার জন্য চোখের জল ফেলেন।
জানেন, ৭ মাস প্রবাস জীবন হয়ে গেলো। আমি এখনও আমার মায়ের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারি না। কথা বললেই কান্না আসে, আর আমার মাও কান্না করেন।
আমি যদি জিজ্ঞেস করি, "কান্না করো কেন?"
মা উত্তর দেন, "তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল!"
আজকের এই পোস্টটা লিখতে গিয়ে অনেকবার কেঁদেছি। কয়েকবারই লিখা বন্ধ করে দিয়ে আবার লিখা শুরু করেছি। কিছু কিছু কথা লিখতে গিয়ে হাত কেঁপেছে।
আমাকে অনেকে দেশ থেকে মেসেজ বা ফোনে বলে, "আমরা ভেবেছিলাম তুই ২ মাসের বেশি বিদেশে থাকতে পারবি না। কিন্তু তুই দিনের পর দিন থাকছিস, কিভাবে?"
আজকে বুঝেছো, আমি কিভাবে থাকি? আমারও মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, "মাগো, আমার আর তোমাদের ছাড়া ভালো লাগে না। দেশে চলে আসি!" কতদিন হয়ে গেলো তোমার হাতে খাই না। কিন্ত আবার মনে পড়ে, আমার তো সফল হতে হবে। তা যেকোন ভাবেই হোক না কেন! আমার থমকে গেলে চলবে না। আমার তো চলতেই হবে।
আজ সন্ধ্যায় আমার বাবা আবার কুয়েত চলে গেছেন। এই বয়সেও বিদেশ করতে চলে গেছেন। আমি জানি, একমাত্র আমার জন্যই গিয়েছেন। নয়তো তার এই বয়সে বিদেশ করার দরকার ছিল না।

আমি সবটা বুঝি বাবা। কিন্তু আমি যে বলতে পারি না, আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে পারি না। জানো বাবা, আমারও খুব ইচ্ছে তোমাকে সুন্দর একটা জীবন দিতে। কিন্তু কি করবো বলো, আমি এমন একটা হতভাগা ছেলে যে তোমার জন্য আজও কিছু করতে পারিনি।
আমার এই ইউরোপ স্বপ্নের মাঝে যদি আমি সফল না হতে পারি বা আমার মাঝপথে মৃত্যু হয়, তাহলে তোমার এই অপদার্থ ছেলেটাকে মাফ করে দিও বাবা🙏

তবে ব্যর্থ খাতায় নাম লিখে দিও না আমার। আমিও অনেক চেষ্টা করছি, অনেক...
একটা কথা জেনে রেখো প্রিয় বাবা-মা, তোমার ছেলে যদি দেশে বেঁচে ফিরে, তাইলে রাজা হয়েই ফিরবে ইনশাআল্লাহ।🥀 তোমরা শুধু দোয়া করো। আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস অব্দি চেষ্টা করে যাবো।

সবশেষে একটা কথা কি জানেন! আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এই ৭-৮ মাস প্রবাস জীবনেই আমি হাপিয়ে গিয়েছি। কিন্তু, আমার বাবা এতোটা বছর কিভাবে পার করলো? প্রবাস এসে আর কিছু না হোক, একটা জিনিস খুব ভালো করেই বুঝেছি, প্রিয়জনের কষ্টের চেয়ে তীব্র কষ্ট পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। যেই কষ্টে প্রতিনিয়ত পুড়ছে হাজার হাজার প্রবাসী।

Sort:  
Loading...